জাতীয় পতাকা শুধু একটি কাপড় নয়। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতীক হচ্ছে আমাদের প্রিয় লাল সবুজ পতাকা। জেনে হোক বা অজ্ঞতার কারণে হোক, জাতীয় পতাকার অবমাননা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জাতীয় পতাকা কীভাবে ব্যবহৃত হবে, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট আইন থাকা সত্ত্বেও অজ্ঞতার কারণে তার লঙ্ঘন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন আনিসুর বুলবুল।
জাতীয় পতাকা বিধিমালা-১৯৭২ (সংশোধিত ২০১০)-এ জাতীয় পতাকা ব্যবহারের বিভিন্ন বিধি-বিধান বর্ণিত হয়েছে। জাতীয় পতাকা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের নিদর্শন। তাই সব সরকারি ভবন, অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ভবনে সব কর্মদিবসে পতাকা উত্তোলনের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া কিছু কিছু অনুষ্ঠান উপলক্ষে যেমন-ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও সরকার প্রজ্ঞাপিত অন্য যেকোনো দিবসে বাংলাদেশের সরকারি, বেসরকারি ভবন ও বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রাঙ্গণে এবং কনসুলার কেন্দ্রগুলোয় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা বাধ্যতামূলক। তা ছাড়া শহীদ দিবস ও জাতীয় শোক দিবসে বা সরকার প্রজ্ঞাপিত অন্যান্য দিবসে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকার বিধান করা হয়েছে।
অর্ধনমিত রাখতে হলে পতাকা উত্তোলনের নিয়ম হলো, অর্ধনমিত অবস্থায় উত্তোলনের প্রাক্কালে পতাকাটি পুরোপুরি উত্তোলন করে অর্ধনমিত অবস্থানে আনতে হবে এবং পতাকা নামানোর প্রাক্কালে পতাকাটি শীর্ষে উত্তোলন করে নামাতে হবে।
ইচ্ছা করলেই যে কেউ গাড়িতে পতাকা ব্যবহার করতে পারে না। কোন কোন ভবনে ও কারা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে পারবেন, এ সম্পর্কে ওই আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে। ওই ধারায় বলা হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন ও অফিসে সব কর্মদিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। ৬ (৩) ধারায় বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর গাড়িতে, নৌযানে ও বিমানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে পারবে। এ ছাড়া স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, চিফ হুইপ, ডেপুটি স্পিকার, জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা, মন্ত্রী সমমর্যাদার ব্যক্তি, বিদেশে বাংলাদেশি মিশনের প্রধানের গাড়িতে ও তাদের নৌযানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে পারবেন। প্রতিমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তি, উপমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তি রাজধানীর বাইরে ভ্রমণকালে গাড়িতে ও নৌযানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে পারবেন।
৭ ধারায় জাতীয় পতাকার মর্যাদা রক্ষার কথা বলা হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। যদি পাশাপাশি ২টি পতাকা উত্তোলন করা হয়, সে ক্ষেত্রে জাতীয় পতাকা ভবনের ডান দিকে উত্তোলন করতে হবে। জাতীয় পতাকার ওপর অন্য কোনো পতাকা উত্তোলন করা যাবে না।
আজকাল খেলার সময়, বিশেষ করে বিশ্বকাপ ফুটবল, বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রেমীরা বাসভবনে নিজ সমর্থনীয় দেশের পতাকা এমনভাবে ওড়ান, যাতে দেশের জাতীয় পতাকা নিচে পড়ে থাকে। কিন্তু কাজটি বেআইনি। কেননা আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পতাকার ওপরে অন্য কোনো পতাকা বা রঙিন পতাকা ওড়ানো যাবে না। মিছিলে পতাকা বহনের বিধান হচ্ছে, পতাকা মিছিলের কেন্দ্রে অথবা মিছিলের অগ্রগমন পথের ডান দিকে বহন করতে হবে। অনেকেই জাতীয় পতাকায় নকশা করে ফ্যাশন হিসেবে ব্যবহার করেন। কিন্তু জাতীয় পতাকার ওপর কোনো কিছু লেখা বা মুদ্রিত করা যাবে না অথবা কোনো অনুষ্ঠান বা উপলক্ষে কোনো চিহ্ন অঙ্কন করা যাবে না; এমনকি জাতীয় পতাকাকে পোশাক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না এবং গায়ে জড়িয়ে রাখা যাবে না। তবে পূর্ণ সামরিক মর্যাদা বা পূর্ণ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ব্যক্তিকে সমাধিস্থ করা হলে তাঁর শবযাত্রায় জাতীয় পতাকা আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
অনুমতি ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে জাতীয় পতাকাকে ট্রেডমার্ক, ডিজাইন বা পেটেন্ট হিসেবে ব্যবহার করাও অপরাধ। কোনো অবস্থায়ই পতাকা নিচে অবস্থিত কোনো বস্তু যেমন- মেঝে, পানি ও পণ্যদ্রব্য স্পর্শ করবে না এবং কবরের ওপরে স্থাপন করার সময় পতাকাটি কবরে নামানো যাবে না কিংবা মাটি স্পর্শ করবে না। পতাকা এমনভাবে উত্তোলন, প্রদর্শন বা মজুদ করা যাবে না, যাতে এটি সহজেই ছিঁড়ে যেতে পারে, মাটি লাগতে পারে বা নষ্ট হতে পারে। কোনো দেয়ালে দ-বিহীন পতাকা প্রদর্শিত হলে তা দেয়ালের সমতলে এবং রাস্তায় প্রদর্শিত হলে উলম্বভাবে দেখাতে হবে। গণমিলনায়তন কিংবা সভায় পতাকা প্রদর্শন করা হলে বক্তার পেছনে ও উর্ধ্বে স্থাপন করতে হবে।
পতাকার মাপ সম্পর্কে ধারণা না থাকায় দেশে বিভিন্ন মাপের পতাকা দেখা যায়। জাতীয় পতাকার মাপ হবে ১০: ৬ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের আয়তাকার ক্ষেত্রের গাঢ় সবুজ রঙের মাঝে লাল বৃত্ত এবং বৃত্তটি দৈর্ঘ্যের এক-পঞ্চমাংশ ব্যসার্ধবিশিষ্ট হবে। ভবনে ব্যবহারের তিন ধরনের মাপ হচ্ছে ১০ ফুটx৬ ফুট, ৫ ফুট x৩ ফুট, ২.৫ ফুট /১.৫ ফুট। তবে অনুমতি সাপেক্ষে ভবনের আয়তন অনুযায়ী এবং দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের অনুপাত ঠিক রেখে বড় আয়তনের পতাকা প্রদর্শন করা যাবে। গাড়িতে ব্যবহারের জন্য মাপ হচ্ছে ১৫ ইঞ্চিx ৯ ইঞ্চি, ১০ ইঞ্চি x৬ ইঞ্চি।
জাতীয় পতাকা কোনো অবস্থায়ই সমতল বা সমান্তরালভাবে বহন করা যাবে না এবং উত্তোলনের সময় সুষ্ঠু ও দ্রুতলয়ে উত্তোলন করতে হবে এবং সসম্মানে অবনমিত করতে হবে। আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলনের সময় জাতীয় সংগীত গাইতে হবে এবং যখন জাতীয় সংগীত বাজানো হয় এবং প্রদর্শিত হয়, তখন উপস্থিত সবাইকে পতাকার দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হবে। মোটরগাড়ি, নৌযান, উড়োজাহাজ ও বিশেষ অনুষ্ঠান ব্যতীত অন্যান্য সময় পতাকা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উত্তোলিত থাকবে এবং সূর্যাস্তের পর কোনো মতেই পতাকা উড্ডীয়ন অবস্থায় থাকবে না।
জাতীয় পতাকা শুধু একটি কাপড় নয়, এটি দেশের স্বাধীনতার প্রতীক। তাই পতাকার অবস্থা ব্যবহারযোগ্য না হলে তা মর্যাদাপূর্ণভাবে সমাধিস্থ করতে হবে। আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, জাতীয় পতাকার প্রতি অবমাননা প্রদর্শন করা বা জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করলে ওই ব্যক্তিকে ১ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।
২০১০ সালের জুলাই মাসে এই আইন সংশোধিত হয়। এই সংশোধনীতে সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত শাস্তি এবং ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়। না জেনে, না বুঝে আর অতি উচ্ছ্বাসে যারা পতাকা ব্যবহারবিধি লঙ্ঘন করেন, তাদের অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে এই শাস্তির বিধান যথাযথ হতে পারে। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান যদি বাণিজ্যিক কোনো প্রচারণায়, বিজ্ঞাপনে জাতীয় পতাকার ব্যবহার বিধিবহির্ভূতভাবে করে থাকে, তার জন্য ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
0 Comments